Tuesday, May 12, 2020

মাতৃদিবস



রুনাই এর বিয়ের পর তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছে সে। মা এর প্রয়োজন তার কাছে ফুরিয়েছে। ছোটবেলায় বাবা মারা যাবার পর মা তাকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছে। কিন্তু শেষমেশ সে মানুষ হয়ে উঠতে পারল কিনা সন্দেহের বিষয়। বিয়ের ৩ মাস পরেই সে ছলে বলে কৌশলে মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে একটা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিল। এখন সে সুখেই তার বউকে নিয়ে সংসার করছে। ছোট পরিবার। সুখী পরিবার। সুখী আছে রুনাই। কারণ, যে মা তাকে নিজের রক্ত দিয়ে মানুষ করেছে, তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েও তার মধ্যে অনুশোচনা একটুও নেই। অনুশোচনাবিহীন মানুষ বেশ সুখী হয়। তাই রুনাই বেশ সুখী। আশালতা দেবী এই ভেবেই নিশ্চিন্ত যে , তাকে ফেলে দিয়ে অন্ততঃ তার প্রাণের টুকরো ছেলেটি সুখী হতে পেরেছে।

********

আজ নাকি মাদার্স ডে। সকাল থেকে বৃদ্ধাশ্রমের অন্যান্য কিছু আবাসিকদের ছেলে মেয়েদের ফোন এসেছে। কেউ কেউ পুরোনো ছবি ফেসবুকে ট্যাগ করে মা কে হ্যাপি মাদার্স ডে উইশ করেছে। তাতেই তাদের কত আহ্লাদ! আশালতা দেবীর বেশ লাগছিল তাদের হাসি হাসি মুখগুলো দেখতে। যদিও পুরোটাই ছলনা, তবুও খুশি হওয়া নিয়ে কথা। এদের সরল ভ্রান্ত খুশি দেখেই মন বেশ ভালো হয়ে গেল তার। কিন্তু মনের একটা দিক অন্ধকার হয়ে রইল রুনাইয়ের জন্যে। রুনাই এরকম আদিখ্যেতা কোনোদিন করেনি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, এটুকু করলে তিনিও আজ গর্ব করে সবাইকে বলতে পারতেন তার ছেলের কথা। মনটা একটু বিষণ্ন হয়ে রইল। চুপ করে পুরোটা দিন কেটে গেল।

********

সন্ধ্যেবেলা একটু ঘরটা অন্ধকার করে শুয়ে আছেন আশালতা। চোখের কোণে অভিমানের চিকচিকে রুপোলি কণা। মনটা বর্ষার আকাশের মত ভারী। এমন সময় দরজায় হালকা টোকা।

"কে?", উঠে বসলেন তিনি এবং হাত বাড়িয়ে বেডসাইড ল্যাম্পটা জ্বালালেন। ঘরের দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাণের টুকরো রুনাই।

"তুই এখানে? কখন এলি বাবা কেউ তো বলেনি আমায়?"

রুনাই ঢুকে এলো ঘরে বিছানায় বসল মা এর পাশে।

"হ্যাপি মাদার্স ডে মা।"

ছেলে এই ২৭ বছরের মধ্যে প্রথমবার তাকে এভাবে উইশ করছে। বিশ্বাস হচ্ছিল না তার। চোখের কোণে জমে থাকা রুপোলি কণা বৃষ্টির জলের মতো ঝরে পড়ল। নিঃশব্দে। অনেক কিছু অভিমান জমা ছিল ছেলের জন্য। ভেবেছিলেন সব অভিমান উগরে দেবেন তাকে সামনে পেলেই। কিন্তু সব যেন গোলমাল হয়ে গেল। সব অভিমান ঝাপসা হয়ে গেল। রুনাই ধীরে ধীরে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। হাত পা গুটিয়ে। যেমন একটি ভ্রুণ আশ্রয় নেয় মাতৃগর্ভে, ঠিক সেভাবেই। বর্ষার বৃষ্টি অঝোরে ঝরে পড়ল।

"আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি মা। আমাকে ক্ষমা করে দিও।"

"এরকম কেন বলছিস বাবা, তুই তো আমার প্রাণ।" , রুনাইয়ের মাথায় হাত রাখতে গেলেন আশালতা ঠিক তখনই অন্ধকার হয়ে গেল। লোডশেডিং।

********

পরদিন সকালে আশালতা দেবীর প্রাণহীন দেহ তার ঘর থেকে পাওয়া যায়। ঘুমের মধ্যেই হার্ট এটাকে মৃত্যু বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু মুখে কোনো যন্ত্রণার চিহ্ন ছিল না। পরম শান্তিতে যেন মৃত্যু হয়েছে তাঁর।

********

আগেরদিন সন্ধ্যেবেলায় গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল রুনাই। মা কে তার থেকে যখন আলাদা করতে হয়েছিল, তখনই তার বাঁচার ইচ্ছেটা মরে গেছিল। কেউ বোঝেনি। মা ও তাকেই ভুল ভেবেছিল। গ্লানি কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছিল তাকে। সংসার তার কখনোই মাকে ছাড়া সুখের হয়নি।  

শেষমেশ আর সে জীবনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে পারেনি রুনাই। কিন্তু মৃত্যুর পরে সে তার মা কেও তার সাথে নিয়ে গেছে চিরনিদ্রায়। পরমশান্তিতে থাকবে রুনাই আর তার মা।

~ প্রীতম গুহ (১০/৫/২০২০)